নীলিমা খাতুন
নীলিমা খাতুন ছুরি শানাচ্ছে
খুন হতে হবে এবার
রক্তের কোষে মেধা আর বোধে
ঢেউ তুলবে না সে আর।
খড়কুটো কিছু ঠোঁটে তুলে এনে
তৈরি করেছি ঘর
শাণিত ছুরির অগ্নিচ্ছটায়
পুড়তেছে সেই খড়।
নীলিমা খাতুন
ছুরির আড়ালে
লুকোচ্ছে সম্ভ্রম।
নীলিমা খাতুন আদিমতা বোঝে
নীলিমা খাতুন ভালো
আড়াল থাকে না খুনের দৃশ্যে
পরদা হলেও কালো।
নীলিমার সঙ্গে কথাবার্তা
আমি: তুমি তো ছবি আঁকো, না?
নীলিমা: আঁকি মানে আঁকতে চেষ্টা করি।
আমি: হ্যাঁ, আঁকতে আঁকতে একদিন এঁকে ফেলবে ছবি। সুন্দরের প্রতি এই মনোযোগ তোমার আছে, আমি জানি।
নীলিমা: (একটু হেসে) তাই?
আমি: তুমি কি মেঘ আঁকতে পারো? শেষবিকেলের নদীতীরে ঝুলে থাকা মেঘ?
নীলিমা: হ্যাঁ, পারি।
আমি: তার নিচে উড়ে যাওয়া একঝাঁক পাখি?
নীলিমা: হ্যাঁ, তাও পারি।
আমি: আচ্ছা ধরো, তার নিচে নদীর ওপর একটা টংঘর, এই ছবিটা?
নীলিমা: এঁকে দিতে পারি।
আমি: এভাবে আঁকতে আঁকতে যদি এঁকে ফেলতে পারো এই ছবি, দেখবে, একজন নির্জন মানুষ নির্জনতা হয়ে টঙের মধ্যে বসে আছে। কী বলবে তুমি তাকে? যে নির্জন হয়ে যায়, তাকে?
বেদনার্ত বালকের মুখ
আয়নার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি
যাকে দেখছি, সে আমি
যাকে দেখছি না, সেও আমি
আয়নায় দ্যাখা যে আমি সে, আয়নার ওই মুখেই
পরিচিত এই জগৎ-সংসারে
আমি জানলাম, এই আয়না অস্বচ্ছ
আরো জানলাম, হৃদয় স্বচ্ছ এক আয়না
এইবার আমি দাঁড়ালাম মনের আয়নার সামনে
আমার ভেতর-বাইরের দুটো সত্ত্বাই এইবার আমি দেখতে পাচ্ছি
শুধু মুছে গেছে মুখচ্ছবি
তার বদলে দেখতে পাচ্ছি প্রবৃত্তির নানা মুখ
কোনো মুখ বীভৎস, কোনোটা হিংস্র
প্রেমিক মুখও দেখতে পাচ্ছি, যে বেদনার্ত বালকের মতো
গোধূলির মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়
এইবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম
এইবার থেকে মনের আয়নায় আমি বেদনার্ত বালকের মুখই দেখব
আমার আরসব মুখ আমাকে ক্লান্ত করে
ক্লান্ত, ক্লান্ত করে, তাই
প্রতিদিন আমি কয়েকশো হিং¯্র মুখ কচুকাটা করি
রক্ত ছিটকে পড়ে আয়নায়
আর প্রতিবার দেখি, নীলিমার নীল
আয়নার ওপর থেকে মুছে দিচ্ছে আমার হত্যার চিহ্ন
স্বচ্ছ আয়নায় তখন আমি দেখি, সূর্যডোবার ঘাটে
বিষণ্ন মুখে বসে আছে এক বালক
মনের আয়নায় এভাবেই আমার মুখগুলো
বেদনার্ত বালকের মুখ হয়ে গেছে হে!
আমাদের কিছু কথা বলা দরকার
আমাদের কিছু কথা বলা দরকার
চুপিচুপি আর, মনে মনে বারবার
আমাদের তো চুম্বন হয়েছে পায়ে
সে এক তেপান্তরের গাঁয়ে
দুপুরের রোদ ছিল ধানখেত জুড়ে
চকচকে সবুজের ঢেউ ছিল দূরে
আমরা ছিলাম মদ্যিমাঠের মাঠে
আমাদের ঘিরে কথারা শুধুই হাঁটে
কথাদের ফিসফাস আর ঘন নিশ্বাস
কাতরতা শুধু আমাদের চোখমুখে
আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে বিশ্বাস
হঠাৎ করেই ভাঙে মানুষের বুকে
আমরা গিয়েছি তেপান্তরের গাঁয়ে
যেতে যেতে হলো চুম্বন তোমার পায়ে
দেবির মতো বললে তুমি, থাক
ঠিক তখনই ডাকল দূরে কাক
তোমার ঠোঁটের নরম গভীরতায়
ডুবে গেলাম গোপন নীরবতায়
বুকের ভেতর ডাক দিল কে, আয়
চুমুর স্মৃতি ওই তো উড়ে যায়
যায় উড়ে স্মৃতি যেন তারও মেঘডানা
স্মৃতি ওড়ে বুক পোড়ে, মন কারখানা!
২১ জুন ২০১৫
চুম্বনে কেঁপে ওঠে দেহের সেতার
আমাকে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিলে
ঘুমায়ে পড়িলাম আমি
ঘুমের ভেতর নদীটদি দেখি
ওগো অন্তর্যামী
আমি তো ওই গ্রীবার নিচে ঠোঁট দিয়েছি ছুঁয়ে
মদ্যিমাঠের তেপান্তরে তোমার পায়ে নুয়ে
দুপুরের মাঠ ছিল সেই চরাচরে
আর ছিল কাতরতা আমাদের স্বরে
চুম্বনে কেঁপে ওঠে দেহের সেতার
মনের গোপন ছুঁয়ে দিল কে তার?
২১ জুন ২০১৫
আমি যা দেখি তা
আমাদের খুব একা একা লাগে তাই
আমাদের এক নদীর তীরে যাই
ধানখেত পাশে রেখে ধুধু পথরেখা
হেঁটে যাই পাশাপাশি গল্পের লেখা।
আমি আর সে এক মাঠ পাড়ি দিয়ে
এক হতে এসেছি কাতরতা নিয়ে
চুম্বনে লালা ঝরে কম্পনে বুক
মুখর হইয়া কথা নাচে ধুকপুক।
ঘন নিশ্বাসে তার বুক ওঠে-নামে
কাতরতা নিয়ে সে দোলে ডানে-বামে
আমিও কাতর তবু, দেখি কাতরতা
আমাদের চারদিকে ছিল নীরবতা।
আমি দুলি যেন আমি আমি নই, আর
নত হয়ে চুমু খাই বাম পায়ে তার
সেজদায় নত হই, হে প্রগাঢ়
আমারে মুগ্ধ করো তো আরও।
তুমি যা তুমি তাই এই তুমি জানো
আমি জানি, কী মায়া পৃথিবীতে আনো
গোধূলির রঙে আঁকা নদীর তীরে
তুমিই ছিলে নীল, আমায় ঘিরে।
চোখে চোখ রেখে তাই মিনিট দেড়েক
নিজজ্ঞানে গেঁথে নিই বোধের পেরেক
ও পেরেক দ্যাখ দ্যাখ, কত দূরে সে
আয়নার দেশ থেকে যেন এসেছে।
আমি যা দেখি তা বাইরে দেখা
ভেতরটাকে সে রেখেছে একা
একা তাই একা একা নদীর তীরে
বারবার কেন তবে যেতে চায় ফিরে
আমাদের খুব একা একা লাগে বলে
আমরা দুজন যাব না কোথাও চলে
আমাদের যে নদী আছে তার কাছে
আমাদের ছায়া কেন আজও বসে আছে?
ছায়া নিয়ে নদীতীর
হাওয়া খায় ঝিরঝির
আর আমি আর সে
দুজনেই আলসে।
একা একা থাকি তাই কথা বলি না
‘কী কথা তাহার সাথে’ তাই বুঝি না
কথা তবু ঢেউ হয়ে ছড়াতেছে বুকে
কী আড়াল খোঁজে সে, দেখি তাই ঝুঁকে।
আমি চাই রক্তে আর তার কোষে
বুদবুদ হয়ে ঠায় থাকব বসে
শুনব কান পেতে তার বোধিকথা
বোধের মধ্যে থেকে উঠে আসা ব্যথা।
চেয়ে থাকি চোখে তার অপলক চাউনি
কী আড়াল বোধে তা বলতে চাওনি
বলবে কেন সে? আমি তো জানি
আমাদের লিখছে অন্তর্যামী।
আমি আর তুমি মিলে গল্পের কাহিনি
পেরিয়ে এক হাজার আরও এক যামিনী
তবু কেন চেনা নয় তোমাকে আমার?
তোমার বোধের ভেতর ইচ্ছে নামার।
যদি দাও অনুমতি ঘুরে আসি প্রভু
দেখে আসি সুন্দর, আড়ালে তবু
যে বলে, সে করে, সেই যায় ঘুমোতে
আমারে পাগল করে প্রগাঢ় চুমোতে।
২২ জুন ২০১৫
মুখ নয় মুখরতা
মুখ নয় মুখরতা
কথা বলে নীরবতা
কী বলে এই ছবি
বলবেন এক কবি
কবি নেই কোত্থাও আশে আর পাশে
বসে থাকো চুপচাপ, চাঁদ কেন হাসে?
হাসে কেন সে আর বুক কেন কাঁপে?
কবি আমি নই তবু কলমের খাপে।
লেখা যা কলমের তার অভিনয়
আয়নার মুখোমুখি হয় বিনিময়
আয়নায় দ্যাখা মুখ তোমার আমার
সত্যি মুখ তবে কোথায় তোমার?
আমারও অচেনা মুখ, তুমি দ্যাখো যা
আত্মায় কান পেতে এক হয়ে যা
ভাষা তো নীরব, তবু বুঝে নিই আমরা
আমাদের অনুভূতি শরীরের চামড়া।
ত্বকে ত্বকে লাগে টান ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি
আমি তো মাখিনি হে, তুই কেন মাখলি?
ধানখেতে রোদ দ্যাখ, সবুজের ঢেউ যে
আমাদের চোখে চোখ, দেখল না কেউ যে।
ছোট ছোট নীলফুল জারুলের গাছে
তার নিচে আমি আর সে খুব কাছে
কাছাকাছি তবু যেন এই যে, এখন
মনে কেন হয়, আমি নই যে তেমন?
যে আমি মুখোমুখি দাঁড়ানো তাহার
সে কী আমার বোধ করেছে আহার?
যদি না করে তবে আমি কেন থাকি?
আমার বোধের ছবি বসে বসে আঁকি।
আঁকি যে মুখ সে নীরবতা বোঝে
ভাষা নিয়ে আমাকে তাই যেন খোঁজে
আমি তার ভাষা খেয়ে করেছি হজম
আমার ভাষা কি বোঝো হে খসম?
২৪ জুন ২০১৫
নীলিমার নীল
নীলিমার নীল উড়ে যেতে যেতে
কিছু এসে পড়ে আমাদের খেতে।
আমরা কৃষক কাঁপতেছি ঠক
এ কী হেরিনু প্রভু
চাষাভুষো তাই দিন কেটে যায়
এ কেমন ছলনা তবু?
আমাদের দিন চড়া রোদে কেনা
মহাজনি দায় রয়েছে দেনা
চোখের এ মায়া কাটাও হে প্রভু
নীলিমার নীল ঝরে পড়ে তবু।
আমাদের ঘর চাঁদে বানভাসি
থই থই চাঁদ, দেহ ভরা হাসি
আসতেছে ভোর, যেতে হবে খেতে
নীলিমার নীল ওড়ে যেতে যেতে।
ধবলার হাটে বেচি লাউ উচ্ছে
আমাদের খুব বেঁচে যে থাকার ইচ্ছে
ঘরে ফিরি তাই গোধূলির পথ ধরে
নীলিমা কেন যে ডেকে হে নিল তোরে?
এই ঘরে হাওয়া বিবি
গান গায় হাবিজাবি
আর তার আদমের হাত
ধরে রাখে আলতো
টুকটুকে গালতো
এভাবেই কেটে যায় রাত।
রাতটাত কাটিয়ে ভোরের দরজা খুলে
সংসারে ঢুকে দেখি, ছায়া ওঠে দুলে
আমি যে ছায়ার মানুষ, সে তবে কার?
এই ভেদ বলো কেন বোঝা দরকার?
ধরো তুমি তুমি নও
আমি যা দেখি তুমি তাই তাই দেখো?
এইবার তাহলে গল্পটা লেখো।
গল্পে থাকবে না মুখোশের মুখ
মুখ নেই মুখোশের, হাঁটে ঠুকঠুক
তুমি যা লেখো সেই অক্ষর ধরে
নেড়ে আর চেড়ে সে দ্যাখে, নড়বড়ে।
মন খুব গোমড়া মুখোশের তাই
যেহেতু তাহার কোনো মুখটুখ নাই
মুখ নেই তবু সে গান কেন গায়?
গল্পে এরকম লেখা কী যায়?
ধরো তুমি তুমি নও, কোনো এক পাখি
তবে কি বলতে, নিচে নেমে আসি?
নীলিমার রঙ নিয়ে ডানায় ডানায়
নদীটদি হুদাহুদি গোধূলি বানায়।
লেখো তবে গোধূলির গন্ধ
যে দ্যাখার সে দ্যাখে, বাকিজন অন্ধ
ছবি আঁকা দুপুরে ছবিদের সাথে
হারানো স্বপ্নগুলো ফেরে অজ্ঞাতে।
জ্ঞাত নই আমি তবু জ্ঞাত তবে কে?
আমার চেতনা জুড়ে ছবি এঁকেছে।
ছবি তো আঁকাই আছে, তাই আমরা
মুছে যাই বলে পিছু ডাকে নামরা।
আমাদের নামের দলিল রাখিনি কোথাও
চেয়ে দেখি উড়ে যায় যা ছিল, তাও
নাম নেই তবু কেন থাকি সামাজিক?
আমাকে দেখাও তো আয়না ম্যাজিক।
মন নাকি হাওয়াঘর আরশিনগরে
গতকাল দেখালো দশটার খবরে
দেখি আমি দ্যাখো তুমি তবু নেই দৃশ্য
মুছে যায় সব রঙ সূর্যের বিশ্ব।
কোনো এক গ্রহলোকে আদিমতম
আমারে গ্রহণ করো, প্রিয় হে তম
তারপর গল্পে লিখবে যা, তা
হয়ে যাবে আমাদের নিয়তির খাতা।
নাম লেখা মোটা খাতা অক্ষরে ধুলো
ফুঁ দিয়ে পড়লাম বোধিকথাগুলো
পরমের রঙ তুমি আর তুমি আড়ালে
হয়ে যাও নীলিমা আমি উঠে দাঁড়ালে।
মুখ নেই মুখোমুখি তবু আছে আয়না
মুখোমুখি দাঁড়ালে কেন দেখা যায় না?
আয়নায় ঝড় ওঠে ঢেকে যায় তুষারে
রাত পাড়ি দিয়ে সে ডেকে আনে ঊষারে।
আমি তো সকাল হবো ঘুম থেকে উঠে
নিজেকেই এরপর খাব খুটেখুটে
হেঁটে হেঁটে দুজনে যাব খুব দূরে
দুপুরবেলার ঘাটে কিছুটা ঘুরে।
তুমিও দাঁড়াও এসে আয়নায়
দ্যাখো তাকে চেনা কেন যায় নাই
ভেতরের মুখ ওই ভেতরে হাসে
বাইরের মুখ যে কেউ ভালোবাসে।
২৬ জুন ২০১৫
নীলিমার নাম কেন ফুল হয়ে ফোটে
বিষণ্ন এই আমাদের নদী নামতেছে তাই সন্ধে
গোধূলির মুখে বসেও বালিকা দুলতেছে এক দ্বন্দ্বে
চুম্বনে তার স্মৃতিরা উধাও কী রূপে এখন বাঁচে?
রূপ তবু নেই প্রভু দেহ তো আছে।
দেহরূপে তাকে পেয়ে দুপুরের মাঠে
মনরূপী নীলিমা একা একা হাঁটে।
একা একা যায় সে, কই যায় রে?
নদীতীরে সন্ধে, ঘুম নাইরে।
যেতে যেতে ঘরবাড়ি সবুজের গ্রাম
মুছে যায় সবকিছু, নীলিমার নাম
বিবিজান বিবিজান ডেকে মওলানা
জালালুদ্দিন রুমি দেন রওয়ানা।
কোনো এক পাহাড়ের চুড়োয় উঠে
নীলিমার নাম কেন ফুল হয়ে ফোটে?
নামে ঘুম নাই বলে মওলানা নাচে
আর বলে, সুন্দর এভাবেই বাঁচে।
২৭ জুন ২০১৫
ভাঙনের গল্প
হিংস্রতা যদি প্রেম
তবে বারুদের কথা লেখো
যৌনতা যদি হৃদয়মন্থন
তবে একটি শশ্মানের ছবি আঁকো
পাখির শিস শুনে
বোশেখের রোদ দেখে
একটি নারীর কথা মনে পড়বে
আমাদের কোনও নদী ছিল না
আমাদের সেই না-থাকা নদীটির
কথাও মনে পড়বে
কেবল মনে পড়বে না ভাঙনের গল্পগুলো।